ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে আমরা সবাই কোনো না কোনো সময় আইফোন ভালো নাকি অ্যান্ড্রয়েড ফোন ভালো এটা নিয়ে ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে তর্ক করার চেষ্টা করেছি। তবে সত্যিকার অর্থে যুক্তি ও যথাযথ রেফারেন্স দিয়ে খুব বেশি মানুষ কথা বলে, বিষয়টা মোটেই সেরকম নয়। তাদের জন্যই আমাদের আজকের এই আলোচনা। কথা না বাড়িয়ে কাজে যাওয়া যাক।
১। কাস্টমাইজেশনঃ
অ্যান্ড্রয়েড হচ্ছে আসলে একটা ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম। সহজভাবে বলা যায়, আমরা প্রথমে একেবারে বেসিক ভার্সনটা নিয়ে এটাকে আমাদের ইচ্ছামত কাস্টমাইজ করতে পারব, আমাদের সুবিধামত পরিবর্তন করে নিতে পারব। অন্যদিকে আইওএস হল একটা ক্লোজড অপারেটিং সিস্টেম, যেটার মানে হচ্ছে এটাকে আমরা চাইলেই পরিবর্তন করতে পারব না। সত্যি বলতে কি, অ্যাপল নিয়ে বহুল প্রচলিত একটা জোক হল “iSheep”, যেটার মানে হল একজন আইফোন ব্যবহারকারীর সামনে অপশন থাকে একেবারেই কম, একটা ভেড়াকে যেরকম কিছু করতে বললে সেটা করতে হয় ঠিক সেরকম আইওএস যেটুকু নির্দিষ্ট করে দেয় তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয় ইউজারকে। তবে এটাকে সত্যিকার অর্থে খারাপ বলা যাবে না, কারণ আসলে জিনিসটা এত সুন্দর করে গোছানো থাকে যে এটা আসলে খুব বেশি পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়ে না। তবে তারপরও মোটের উপর বলা যায় যে অ্যান্ড্রয়েডের ওপেন সোর্স প্রজেক্টই মানুষের কাছে বেশি সমাদৃত হচ্ছে। আবার ইউজার ফ্রেন্ডলি বলে কিন্তুু অ্যাপেলই বিখ্যাত।

২। পারফরম্যান্সঃ
এটা আসলে একটা বেশ বড় পরিসরের আলোচনা। ইউজার ফ্রেন্ডলি কোনটা সেটা এক কথায় বলে দেওয়া যায় অ্যান্ড্রয়েড। তবে ঠিক এই কারণেই অ্যান্ড্রয়েডের সবচেয়ে বড় অসুবিধাটার সৃষ্টি হয়েছে। আর সেটা হল অ্যাপ্লিকেশন গুলো রান করতে প্রচুর সময় নেয়। আর ডিভাইস হ্যাং হয়ে যাওয়ার কথা তো ছেড়েই দিলাম। ইউজার ফ্রেন্ডলি করার সাথে সাথে যেটা হয়েছে সেটা হল তাদের প্রোগ্রামে প্রচুর লুপ হোল (বিষয়টা না বুঝলে কোনো ব্যাপারই না, জাস্ট ধরে নাও যে হ্যাং হওয়ার পিছে এটা একটা প্রধান কারণ) সৃষ্টি হয়েছে। এরকম বিভিন্ন কারণ আসলে ইউজার ফ্রেন্ডলি করার সাথে সাথে অ্যান্ড্রয়েডের বেশকিছু সমস্যারও সৃষ্টি করেছে।
অন্যদিকে অ্যাপলের নির্দিষ্ট একটা গঠনের জন্য তাদের প্রোগ্রামে বাগ এবং লুপ হোল নেই বললেই চলে। তাই যারা আইফোন ইউজ করে তারা এধরনের স্লো পারফরম্যান্স অথবা বারবার হ্যাং করা টাইপের সমস্যার সামনে পড়ে না। অ্যাপ রান করার আগে কোনো ধরনের অ্যানিমেশন না দেখানোর জন্যও তাদের অ্যাপগুলো খুবই দ্রুত শুরু হয়। অন্যদিকে অ্যাপল যে ইউজার ফ্রেন্ডলি না সেটাও না, একজন নিয়মিত আইওএস ইউজার অবশ্যই আইওএসই বেশি পছন্দ করবে।
৩। ক্যামেরাঃ
বাংলাদেশের ৭৫% কমবয়সী মেয়েকেই আসলে যত ভালো ফোনই দেওয়া হোক না কেন সেই ফোনের ক্যামেরা যদি অসাধারণ না হয় তাহলে সেটাকে একেবারেই গারবেজ হিসেবে ধরে নেবে। আসলেই যেকোনো ফোনেই ক্যামেরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ।
ক্যামেরার কথা বললেও আমাদের অবশ্যই আইফোনের ক্যামেরাকেই এগিয়ে রাখতে হবে। সাহিত্যিকদের মত বলতে গেলে আসলে বলতে হয়, স্মার্টফোনে ভালো ক্যামেরার অগ্রদূত হল আইফোন। যদিও অনেকেই স্বল্প আলোতে ও বিভিন্ন সময়ে তাদের ক্যামেরার পারফরম্যান্স নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে। তারপরও এখন পর্যন্ত আইফোনের ক্যামেরার চাইতে ভালো ক্যামেরা আমরা পাইনি, এটা নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া যায়।
অ্যান্ড্রয়েড এক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে Samsung Galaxy S6 এবং LG, Huawei, HTC এদের বিভিন্ন সেট আমাদের অসাধারণ কিছু ফটোশুটিং অভিজ্ঞতা দিচ্ছে। Galaxy S6 Edge আসলে অনেকের মতেই আইফোনের সমকক্ষ কিংবা তার চাইতেও ভালো ক্যামেরা সম্পন্ন একটি ফোন। কাজেই এক্ষেত্রে অ্যান্ড্রয়েডও পিছিয়ে আছে এটা কোনোভাবেই বলা উচিত হবে না।
এখানে নিজেরাই তুলনা করার জন্য দুটি ছবি দিয়ে দিচ্ছি।

৪। ডিসপ্লেঃ
এক্ষেত্রে সম্ভবত অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস প্রায় সমানে সমান বলাই যায়। iPhone 6 এবং iPhone 6 Plus কে Best Mobile LCD Display এবং Galaxy S6 and Galaxy Note 4 কে Best Mobile OLED Display বলা হয়। সত্যি করে বলতে কি, অ্যান্ড্রয়েড খুব হাল্কা ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও এক্ষেত্রে তেমন কোনো পার্থক্য করা যায় বলে মনে হয় না। তবে অ্যান্ড্রয়েডের অধিকাংশ ফোনএ এখনো 2K ডিসপ্লে ব্যবহার করা হয় যেখানে আইফোন 720p এবং 1080p ডিসপ্লে ব্যবহার করে থাকে।
৫। কম্পোনেন্টঃ
এক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাই অ্যান্ড্রয়েডের আধিপত্য। তারাই সাধারণত র্যাম, রম, গ্রাফিক্স, ব্যাটারি লাইফ, এসব ক্ষেত্রে আমাদের একটা ভালো ফোন উপহার দেয়। কিছুদিন পরেই বের হতে চলা Oneplus 3 আমাদের প্রথম বারের মত ফোনে 6 GB র্যাম দিচ্ছে, যেখানে iPhone 6 এর র্যাম ছিল 1 GB। তবে বিষয়টি হল, আইওএসের প্রোডাক্ট গুলোর কোয়ালিটি আসলে খুবই ভালো, তাই এর পারফরম্যান্স হয় অসাধারণ। অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা অ্যান্ড্রয়েডে ত্রুটিপূর্ণ হার্ডওয়্যারের জন্য নিম্নমানের পারফরম্যান্স দেখতে পাই।
৬। অ্যাপসঃ
অ্যান্ড্রয়েডের জন্য যে অ্যাপ স্টোরটি আছে সেটি হল গুগল প্লে স্টোর। আর আইফোনে আছে আইওএস অ্যাপ স্টোর। এই ২ টি স্টোরই আসলে খুবই সমৃদ্ধ। প্লে স্টোরে প্রায় ১.৬ মিলিয়ন আর আইওএসে স্টোরে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন অ্যাপ রয়েছে। যদিও প্লে স্টোরই অ্যাপের ক্ষেত্রে বেশি জনপ্রিয় এবং বেশি সমৃদ্ধ, অ্যাপলও এক্ষেত্রে কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। আমাদের প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের কাজের জন্যই আসলে কোনো না কোনো অ্যাপ খুঁজে পাওয়া যায়। এরপরও পৃথিবীর সৃষ্টিশীল মানুষেরা অসাধারণ সব অ্যাপ বানিয়ে যাচ্ছে, যা আমাদের জীবনে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে চলেছে। কিন্তুু অ্যাপেল এর প্রাইভেসি সংক্রান্ত কারণে আইফোন এ বিনামূল্যে গান ও ভিডিও নামানো যায় না। আবার আইওএস অ্যাপ স্টোরএ অনেক অ্যাপএর জন্যই টাকা দিতে হয় যা প্লে-স্টোরে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।
৭। সহজলভ্যতাঃ
আইফোন গুলোর একটা বড় প্রতিবন্ধকতা হল এর বাজেট প্রাইস অনেক বেশি। আর এ কারণেই হয়তো আমাদের দেশে আইফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা এত কম। অনেকেই মনে করেন ব্র্যান্ডের জন্যই এত টাকা খরচ করার কোনো মানে হয় না। যদিও প্রকৃতপক্ষে আইফোন আমাদের এত ভালো সার্ভিস দিয়ে থাকে যে একটু বেশি দামের জন্য তাদের দোষারোপ করাটাও ঠিক সমীচীন নয়।
অন্যদিকে অ্যান্ড্রয়েডের কিছু ফ্ল্যাগশিপ সহ বেশিরভাগ ফোনই তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম দামে পাওয়া যায়, যে কারণে অনেকেই অ্যান্ড্রয়েড ফোন কিনতে বেশি উৎসাহী থাকেন।
যেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেটা নিতান্তই মৌলিক কিছু বিষয়। এটা এত বিশাল একটা টপিক যে কিছুক্ষণের মধ্যে খুব সহজে আলোচনা করাটা খুব সোজা না। তারপরও যে বিষয়গুলো না জানলেই নয় সেরকম কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরে জিনিসটা একটু পরিষ্কার করার চেষ্টা করা হল। এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে এখানে ঘুরে আসতে পারোঃ
Differences between Android and iPhone
তাহলে পরের বার থেকে হয়তো আমরা কিছুটা হলেও বেশি জ্ঞান নিয়ে এধরনের আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারব। বলা তো যায় না, কখন আবার কে আমাদের “Tech Noob” উপাধি দিয়ে দেয় ভুল্ভাল বলার জন্য!
Leave a Reply